ধর-ধর, চোর-চোর, কে কোথায় আছিস এগিয়ে আয়, হঠাৎ করে অনেক লোকের ডাক চিৎকার। মানুষ ঘর থেকে বাহির হয়ে ছোটা-ছুটি করছে। তখন সন্ধা রাত, শীতের কোয়াশায় সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায় নাই। কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে আছে সারাদেশ। সবুজ গাছের পাতার ওপর ঝিরি-ঝিরি বৃষ্টির মতো শিশির ফোটা পরছে। শীতের তিব্রতা সইতে না পেরে কেউ-কেউ রাসত্দার পাশে খরকুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহাচ্ছে। আমি আমার খালাতো ভাইয়ের সাথে বিছানায় লেপের ভেতরে পা দিয়ে গোল হয়ে বসে দাদুর কাছে গল্প শুনছি হঠাৎ মানুষ জনের ডাক চিৎকার শুনে আমরাও লাফিয়ে উঠলাম। দৌড়ে বাড়ি থেকে বাহির হলাম। বাড়ী থেকে রাস্তায় বাহির হতেই আমার খালাতো ভাই কাউছার কোয়াশার অন্ধকারে পাশের বাড়ীর ভাবির সাথে ধাক্কা খেয়ে রাসত্দায় পরে যায়। ভাবি কাউছারকে না চিনে কান চেপে ধরে। আমি কাউছারকে ছাড়িয়ে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে আবার দৌড়ে লোকজনের দিকে গেলাম। অনেক মানুষ জমে গেছে। কি হয়েছে কি হয়েছে বলে সবাই এদিক সেদিক ছুটছে, একে ওকে জিজ্ঞাসা করছে। আমরাও আগ্রহের সাথে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জানতে পারলাম মজিদ কাকার বাড়ীতে চোর ঢুকেছিল। আমি মজিদ কাকার নিকট জিজ্ঞাসা করলাম। মজিদ কাকা বললো আমার বারান্দায় চাদর মেলা ছিল। চোর চাদর নিয়ে যাওয়ার সময় আমি দেখে চোরকে ধাওয়া করি। তবে চোর দুরে কোথাও যেতে পারে নাই, আমার ধারণা চোর আসে পাশেই আছে। মজিদ কাকার কথা শুনে লোকজন চোর খুঁজতে থাকে। মজিদ কাকার বাড়ীর পাশে একটি বদ্ধ পুকুর আছে। পুকুরে কোচুরি পানা দিয়ে ভরে গেছে। সবার ধারণা পুকুরে পানির ভেতরেই চোর আছে। লোকজন কেউ-কেউ অতি উৎসাহি হয়ে পুকুরে নেমে পরলো কেউ বাশের লাঠি হাতে নিয়ে কচুরি পানা সরায়ে টর্চ লাইট দিয়ে চোর খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে দেখাযায় পানির ভেতরে একজন মরা মানুষের মতো পরে আছে। লোকজন পানির ভেতর থেকে লোকটিকে ধরা-ধরি করে উপরে উঠায়ে আনে। লোকটিকে উপরে এনে দেখে লোকটি ঠান্ডা পানিতে বরপের মতো জমে গেছে। লোকটির গায়ে পেছানো ছিল মজিদ কাকার বাড়ী থেকে চুরি করে নেওয়া চাদর এ ছাড়া আর কিছু তার গায়ে ছিল না। সবাই দেখলো এই ব্যাক্তিই তাহলে চোর। চোরকে উপরে এনে মারধর করবে তো দূরের কথা মরনাপন্ন অবস্থা থেকে বাচানোর জন্য চোরের শরীর শুকনা কাপর দিয়ে মুছে হাত পায়ে তেল মালিশ করতে থাকে। তখন চোরের কোন হুশ নাই। শীতের মধ্যে বদ্ধ পুকুরের পানিতে চোরের শরীরের রক্ত বরফ হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষন থাকলে হয়তো মারা যেতো। সবাই ধরে আলোতে আনার পর দেখা যায় চোর আমাদের গায়ের দক্ষিণ পাড়ার জুড়ান ভাই। জুড়ান ভাই অত্যান্ত গরিব মানুষ। দিন মুজুর হিসাবে পরের জমিতে কাজ করে যা পায় তাই দিয়ে সংসার চালায়। বাড়ীতে ছনের একটি ঘুপরি ঘর আর দুচারখানা হাড়ি পাতিল ছাড়া সংসারে আর কিছুই নাই। দুই ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে অতি কষ্টে জীবন চলে তার। জুড়ান ভাই আগে কখনো চুরি করেছে এমন কথা কেউ কনোদিন শোনে নাই। সবাই মিলে হাত পায়ে তেল মালিশ করে যখন চোর সুস্থ হচ্ছিল না তখন মজিদ কাকা বললো তারাতারি হাসপাতালে নেওয়ার জন্যে। কয়েকজন মিলে জুড়ান ভাইকে একটি ভ্যান গাড়ীতে তুলে থানা সদরে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। মজিদ কাকা আমাকে বললো শরিফুল তুমি তোমার বন্ধুকে সাথে নিয়ে জুড়ানের বউকে খবরটা দিয়ে এসো আর আমি হাসপাতালের দিকে যাই। আমি আমার খালাতো ভাই কাউসার আর আমার বন্ধু মাসুদকে সাথে নিয়ে দক্ষিণপাড়া জুড়ান ভাই এর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাদের পাড়া থেকে দক্ষিণপাড়া যেতে বড় একটা মাঠ পাড়ি দিতে হয়। রাত খুব বেশী না হলেও শীতের কুয়াশায় যেনো পৃথিবী ঢেকে আছে। মাঠে ছোট-ছোট ধান আর ধানের ক্ষেতে পানি আছে, পানির সাথে কুয়াশার গভীর বন্ধুত্ব , বন্ধুত্ত্বের টানে কুয়াশা পানির সাথে মিশে আছে মিলন মেলায়। ঘন কুয়াশায় টর্চ লাইট ধরলেও একহাত সামনের কিছুই দেখা যায় না। আমরা তিনজন কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ক্ষেতের সরু আইল দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাঠের মাঝা-মাঝি আসতেই একসাথে ওনেকগুলো শেয়াল হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া বলে ডেকে ওঠে। শেয়ালের ডাক শুনে কাউছার ভয়ে লাফিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। কাউছারের জন্ম শহরে, শহরেই ও বড় হয়েছে। শীতের ছুটিতে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে শীতের সকালে ঠন্ডা খেজুর রস, মায়ের হাতের গরম-গরম ভাপা পিঠা আর দুতকুলি পিঠা খাওয়ার জন্যে। শেয়ালের ডাক কনোদিন শোনে নাই। এইরকম একটা ঘটনা ওর কাছে নতুন কিছু মনে হচ্ছে। আমাদের তিনজনেরই শীতের কাপড় পরা থাকলেও হাত পা ঠন্ডায় জুমে আসছে। কুয়শা ঘেড়া দূর্গম পথে বীর যোদ্ধার মতো লাইট হাতে নিয়ে শিশির ভেজা পথে কুয়াশার বুক ফাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলছি বীর দর্পে। আমি আগে, কাউছার মাঝে আর পিছনে বন্ধু মাসুদ শীতে কেপে-কেপে দৃঢ় পায়ে হাটছি, হঠাৎ পিছনে ছপাত করে শব্দ হলো। আমি শব্দ শুনে পিছন দিকে লাইট ধরে তাকিয়ে দেখি মাসুদ পা পিছলে ধান ক্ষেতের কাদার ভেতরে পরে গেছে। কাউছার খিক খিক করে হেসে উঠলো আমারও হাসি পেলো কিন্তু আমি হাসি চেপে গেলাম। তারাতারি মাসুদের হাত ধরে টেনে তুললাম তৎক্ষনে মাসুদের কাপড় চোপড় ভিজে গেছে, কাদায় শরীর মেখে গেছে। দুঃখ লাগলেও মাসুদকে বললাম দোস্ত কি করবে বলো 'কপালে আছে ঘি, না খেয়ে করবা কি' চলো জুড়ান ভাই এর বাড়ীতে তো যেতেই হবে। তিনজনে অনেক কষ্টকরে জুড়ান ভাই এর বাড়ীতে পৌছিলাম। বাড়ীর ভেতরে ডুকতেই দেখি ছোট্ট একটা ছনের কুঁড়ে ঘর, ঘরের দড়জায় চট টাঙ্গানো, ছেড়া চটের ফাঁক দিয়ে ঝিড়ি ঝিড়ি ঠাণ্ডা বাতাস ডুকছে ঘরের মধ্যে। একটি কুপি বাতাসে নিভু নিভু করে জ্বলছে মেঝেতে। ঘরের এক কোনে কিছু খর বেছানো তার ওপর একটি জীর্ন কাথা বিছিয়ে জুড়ান ভাইয়ের তিন ছেলে মেয়ে শুয়ে শীতে কাঁপছে। গায়ে দেয়ার মতো কোন কাথা বা কম্বল নাই। ওদের পরনে একটা করে জামা তাও আবার হাফ হাতা। শীতের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে জুড়ানের বউ চুলার ওপর বসে আগুনের তাপ পোহাচ্ছে। চুলার মধ্যেও আগুন যেনো শীতে জুমে আছে। আমারা জুড়ানের তিন ছেলে মেয়ের কষ্ট দেখে নিথর মুর্তির মতো দাড়িয়ে রইলাম। মুখে কিছু বলার মতো ভাষা পাচ্ছিলাম না। মনে হলো হায়রে পুথিবী কেউ-কেউ অট্টালিকায় ঘরে রুম হিটার লাগিয়ে, লেপ তোশক, বিলাশী চাদর, জ্যাকেট পরে মহাসুখে বিলাশিতা করছে আর জুড়ান ভাই এর মতো সৎ নিষ্ঠাবান দিন মুজুর ছেলে মেয়েদের এক টুকরা গরম কাপর জোগার করতে পারে না। জুড়ান ভাই স্ত্রী-সন্তানদের কষ্ট সইতে না পেরে হয়তো বা মজিদ কাকার বাড়ীতে গিয়েছিল একটা কাপড় চুরি করার জন্য! এ এমন কি অপরাধ? আর তার জন্য আজ তাকে হাসপাতালে যেতে হলো। ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ওদের কষ্ট দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে লাগলো। আমি সহ্য করতে না পেরে আমার গায়ে থেকে চাদর খুলে ওদের গায়ে চাদর জড়িয়ে আমার বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কাউছার বললো্ল শরিফুল গ্রামের মানুষ এতো কষ্ট করে তা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না। কাউছারের চোখেও পানি ধরে রাখতে পারল না। ওর গায়ে থেকে চাদর খুলে জুড়ানের বউয়ের গায়ে জড়িয়ে দিল। এমন অবস্থায় জুড়ান ভাই হাসপাতালে এই কথা কিভাবে বলবো ভাবতে পারছিলাম না। মাসুদ নিজের কষ্ট ভুলে জুড়ান ভাইয়ের বউকে বললো ভাবি আমরা আপনাকে একটা খবর দেওয়ার জন্য এসিেছ। জুড়ান ভাই হাসপাতালে...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম
ভীষণ কষ্টদায়ক গল্প -আমাদের আশেপাশেই এমন করেই কষ্টে আছে হাজারও জুড়ান ভায়ের পরিবার অথচ আমরা জানিনা বা জানলেও কিছু করতে পারিনা । উদ্যোগ নিলে যুব সমাজই পারে তাঁদের নিজেদের এলাকার সমস্যাগুলি সামান্য হলেও সমাধান করতে । আপনার গল্প লেখার হাত ভাল তবে বেশ তাড়াহুড়া করেছেন । একটা লেখা লিখে নিজেই বেশ কয়েকবার পড়লে ছোট ছোট ভুলগুলি নিজেই ধরা সম্ভব -আর যদি একটু প্যারা করে লিখতেন তাহলে গল্পটি দেখতে সুন্দর যেমন লাগত তেমনি পাঠকেরও পড়তে আরও একটু সুবিধা হত । আগামীতে আরো লেখা পাবার প্রত্যশায় শুভকামনা ।
মিজানুর রহমান রানা
হায়রে পুথিবী কেউ-কেউ অট্টালিকায় ঘরে রুম হিটার লাগিয়ে, লেপ তোশক, বিলাশী চাদর, জ্যাকেট পরে মহাসুখে বিলাশিতা করছে আর জুড়ান ভাই এর মতো সৎ নিষ্ঠাবান দিন মুজুর ছেলে মেয়েদের এক টুকরা গরম কাপর জোগার করতে পারে না। ---------চমৎকার কথা তুলে ধরেছেন------
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।